প্রদীপ জ্বালাবেন তো আদৌ? - সৌপ্তিক ঘোষ


           ২-রা এপ্রিল থেকে সোস্যাল মিডিয়ায় সেই একই জিনিস বারবার নজরে আসছে- তা হল পরের দিন সকাল ৯ টা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পুনরায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। দেশের এই দুর্দিনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ অনেকটা কড়া পাঁচনের মতো। ঠিক নিয়মমতো মেনে চলতে পারলে আরোগ্য লাভ অবশ্যম্ভাবী; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা মেনে চলাটাই ভীষণ কষ্টকর। বিশেষ করে মানুষ যেখানে আধপেটা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে, সেখানে রোজগারের সন্ধানে না বেরিয়ে ঘরে বসে জীবনযাপন- নেহাতই বিলাসিতা! কিন্তু ওই যে সতর্কবাণী ভুলে গেলে চলবে না- অযথা ভিড় জমানো যাবে না, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে; এসব ভেবেই তো বাইরে বেরোনো আর হয়ে ওঠে না। যদি কোনোক্রমে এদিক থেকে ওদিক কিছু হয়ে যায়, ব্যাস্ লেগে যাবে যমে-মানুষে টানাটানি।

                        এই কথাটা অস্বীকার করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না যে, ভারত সুবৃহৎ অর্থনীতির দিক দিয়ে বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম স্থান অধিকার করলেও, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় এদেশ এখনও অনেকটাই অনুন্নত। ওষুধের যোগান কম, হাজার জন প্রতি ডাক্তার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা কম, কম আইসোলেশন স্কোয়াডের সংখ্যাও। কিন্তু এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও করোনা প্রতিরোধে ভারত আজ অনেকাংশে সফল হয়েছে। আর শুধু তাই নয়, স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এমনটাই ঘোষণা করেছে যে, ভারতই হল বর্তমানে বিশ্বের ১ নম্বর দেশ যে করোনা প্রতিরোধে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই সফল হয়েছে। হ্যাঁ, আক্রান্ত অবশ্যই হয়েছে এখানে, মারাও গেছেন অনেকে তবুও সমগ্র পরিসংখ্যান এখনও অবধি অন্যান্য অনেক উন্নত পরিকাঠামোসম্পন্ন দেশের তুলনায় বেশ ভালো।

                             আর এই সফলতার পেছনে দুটো বিষয়ের অবদান অনস্বীকার্য। প্রথমটা যদি হয় ভারতের মৌসুমী জলবায়ু, দ্বিতীয়টা তবে অবশ্যই ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জণগণ যারা কেন্দ্র ও রাজ্যের সাথে তালে তাল মিলিয়ে করোনা প্রতিরোধে শামিল হয়েছেন। যারা এখনও রীতিমতো লকডাউন মেনে চলেছেন। তবে এটাও অস্বীকার করা যায় না যে, লকডাউন সর্বত্র ঠিকমতো পালনও হচ্ছে না। মানুষের মধ্যে এখনও যথেষ্ট সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। রাস্তার মোড়ে, পাড়ার চায়ের দোকানে আজও মানুষ ভিড় জমাচ্ছে। কিন্তু কেন? তাদের নিজেদের কী প্রাণের মায়া নেই? নাকি, যারা সুস্থ আছেন তাদেরকেও অসুস্থ করার দায়িত্ব নিয়েছে ওরা। বিশ্বের এই চরম সংকটজনক পরিস্থিতিতে যেখানে দেশের পর দেশ শ্মশান হয়ে যাচ্ছে সেখানে লকডাউন মেনে চললে যদি এই করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারা যায়, তবে তা মেনে চলতে আপত্তি কীসের?

                           এরকম এক দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে ৩-রা এপ্রিল ঠিক সকাল ৯ টা নাগাদ যখন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে বসলাম, ভেবেছিলাম, হয়তো উনি এবার আরও কঠোর কিছু সিদ্ধান্ত নেবেন- লকডাউন আরও বাড়াবেন, অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করবেন, দেশজুড়ে আরও নতুন হসপিটাল গড়া কিংবা প্রতিটা হসপিটালে আরও অতিরিক্ত স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের কথা বলবেন, কেন্দ্রের ১লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের পাশাপাশি গরীব মানুষদের জন্য হয়তো আরও বাড়তি কোনো সুবিধার কথা ঘোষণা করবেন। কিন্তু না, আমার ভাবনাগুলো কোথাও যেন একটু ধাক্কা খেলো। আসলে সেসব কিছুই যে হল না। বরং যেটা হল সেটা আমি ভাবিই নি কখনও। এই ৫-ই এপ্রিল, রবিবার, ঠিক রাত ৯-টার সময় ৯ মিনিটের জন্য বাড়ির সমস্ত আলো বন্ধ করে ব্যালকনি, ছাদ কিংবা দরজার মুখে দাড়িয়ে দেশের মানুষের মধ্যে একতা বজায় রাখার জন্য মোমবাতি, প্রদীপ অথবা মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালানোর কথা ঘোষণা করলেন তিনি। এ যেন এবছরের ২২-শে মার্চে ঘটে যাওয়া "জনতা কার্ফু"-র আরেক প্রতিফলন ঘটতে চলেছে। পাশাপাশি তিনি সকলকে বাড়িতে থেকেই এটা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন; কেন না, ২২-শে মার্চের বিকেলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে জনসমাগম ঘটেছিল তা রীতিমতো ভীতিজনক।

                             তো, ঘোষণাটা শেষ হয়েছে কী হয়নি! ব্যাস্, সোস্যাল মিডিয়ায় আবার যুদ্ধ শুরু। মানুষ ভাগ হয়ে গিয়েছে দুটো ভিন্ন মতাদর্শে। একপক্ষের মতে- মানুষের বাঁচামরা আজ যেখানে অনিশ্চিত সেখানে এসব হাস্যকর কার্যক্রম নেহাতই বিলাসিতা। অনেকে তো আবার কটাক্ষ করে এও মন্তব্য করেছেন যে, "জনতা কার্ফুতে যেভাবে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল, এই অকাল দিওয়ালী-তে না আবার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে বসে"! আবার আরেক পক্ষের মতে- দেশবাসীর একতা বজায় রাখার জন্য, মানুষের মনের ভয়টাকে কাটানোর জন্য এই পন্থা সকলের মেনে চলা উচিত।

                               এখন প্রথম পক্ষের যুক্তিগুলো গ্রহনযোগ্য হলেও দ্বিতীয় পক্ষের দাবীটা আরও বেশি গ্রহনযোগ্য। না না, আমি এমনি এমনি এত বড়ো কথা বলে ছেড়ে দেবো না সাথে কারণও দেখাবো তার পেছনে-

১/ যখন গ্যালারিতে বসে আমরা হাইভোল্টেজ ম্যাচ দেখি তখন নিজেদের দলের জয় ঠিক যে মুহূর্ত থেকে একটু একটু করে কাছে আসতে শুরু করে সেই মুহূর্ত থেকে গ্যালারিতে আমরা আমাদের ফোনের ফ্ল্যাশলাইটগুলো একে একে জ্বালাতে শুরু করি কেন? শুধুই উপভোক্তা বলে! নাহ্, তা মোটেও নয় বরং এটা বোঝাতে চাই যে- দল তুমি লড়তে থাকো, আমরা তোমার সাথে আছি; আর এই আশ্বাসটাই দলের মনোবল বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। ঠিক তেমনি দেশমাতৃকা সহ দেশের আপামর জণগণ যখন এই চরম সংকটময় পরিস্থিতিতেও লড়ে চলেছে তখন প্রত্যেকে প্রত্যেককে একে অপরের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে নিজেদের মনোবল বাড়াতে তথা মনের ভয়টাকে কাটাতে, সমস্যা কোথায়?

২/ যখন কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়, তখন আমরা মোমবাতি মিছিল বার করি কেন? মোমবাতির আলোর তাপে কী ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়? তা তো মোটেও নয়। বরং আমরা সেই মেয়েটার আত্মার শান্তি কামনা করতে সংঘবদ্ধ হই। ঠিক তেমনি এই রবিবারও আমরা সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে যার বাড়ি থেকেই করোনায় মৃত সকলের আত্মার শান্তি কামনা করবো।

                                  চলুন না তবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের খাতিরে দশের খাতিরে দেশমাতৃকার মঙ্গল কামনা করে জ্বেলে দিই মোমবাতি-প্রদীপ অথবা মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট। যতই হোক-

               "সকলের তরে সকলে আমরা-

                প্রত্যেকে আমরা পরের তরে"॥

You Might Also Like

0 Comments